"উফফ মা সবসময় কেন যে এত ঘ্যানঘ্যান করো এক টাকা নিয়ে আর ভাল্লাগেনা। রাখো ফোন" বলেই
খট করেই কেটে দেয় ফোনটা।চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। নাহ,ছেলে মানুষের চোখের জল মানায় না।
কিছু একটা করা লাগবে।ঘরে অসুস্থ বাবা-মা আর বোন না খেয়ে আছে।
অথচ আজ টিউশনের টাকা টা পাবার কথা ছিল।বড়লোকের নামীদামী বাড়িতে সে এক ছাত্রী পড়ায়।ছাত্রীর বাসার সবাই গেছে বান্দরবান ট্যুরে। নিজের কপালের কথা ভেবে মনে মনে হেসে নেয় সাজ্জাদ। তার খাবার টাকা নেই আর ছাত্রীর বাসায় টাকা রাখার জায়গা নেই।
ছাত্রীর পড়ায় মন নেই তাও তাকে নিয়ম করে ঘন্টা দুই পড়ার টেবিলে বসে থাকা লাগে।
সাজ্জাদের ইচ্ছে হয় টিউশন ছেড়ে দিয়ে চলে যায় কোথাও কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ে বাবা-মাকে খাওয়াবে কি!এই টিউশনের টাকাই তো তাদের সম্বল।
সাত-পাঁচ ভেবে সে ছেঁড়া জুতাটা পায়ে দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে যায় বন্ধু রনির কাছে।
যদি কটা টাকার যোগাড় হয়!
রনির মেসে গিয়ে দেখে তার রুমে অনেক মানুষ। আড্ডা দিচ্ছে বসে।সামনে নানারকম খাবার সাজানো।খাবার দেখে সাজ্জাদের পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো।গতকাল রাতে টাকা দিয়ে শেষ মিলটা খেয়েছে।এরপর টাকা না দিলে আর একবেলার খাবার ও মিলবেনা।অথচ বেলা দুইটা বাজে এখনো তার পেটে দানাপানি নেই।থাকবে কি করে?
পকেটে যে একটা টাকাও নেই।
"আরে সাজ্জাদ যে!কখন এলি?"রনির ডাকে সম্বিতে ফিরলো সাজ্জাদ।
"এইতো এলাম তোর কাছে একটা দরকারে"
-কি দরকার? কিছু বলবি?
-আসলে আমার কিছু টাকার দরকার।ধর হাজার দেড়েক।সামনের মাসে টিউশন এর টাকাটা পেলেই তোকে শোধ করে দেবো।
কাচুমাচু করে রনি বললো,
-দেখ বন্ধু,এইমাসে আমার হাতও একদম খালি।আর তুই তো জানিস এই মাসেই নিলার বার্থডে। সবে সম্পর্ক শুরু হয়েছে আমাদের। কিছু একটা গিফট না দিলে যে আমার মান-ইজ্জত থাকেনা রে।সরি রে।কিছু মনে করিস না।দেখ সবাই কেমন আড্ডা দিচ্ছি। আয় বোস,কিছু খেয়ে যা।
-নারে এখন খিদে নেই।তাছাড়া টিউশনের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।যাই রে।
বলেই সাজ্জাদ বেড়িয়ে গেলো।আজ তার বাড়িতে চাল নেই।মা বাবা না খেয়ে আছে আর সে এত অভাগা একটা ছেলে যে কিনা কোনো সাহায্যই করতে পারছেনা।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে ফিরে যায় তার শৈশব এর দিনগুলোতে।
কতই না রঙিন ছিল দিনগুলো।
তার স্কুল-মাস্টার বাবা সাইকেল চালিয়ে তাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন।
রাস্তায় কিছু একটা দেখলেই সে বায়না করতো বাবা এটা কিনে দাও,সেটা কিনে দাও আর তার বাবাও ছেলের আবদার পূরনের জন্য উঠে পড়ে লাগতেন।
বাড়ি এসে মায়ের বকুনি খেতে হতো,"আর মনে হয় কারো ছেলে নাই।তোমার ছেলেই রাজ্যের জিনিস কিনে দেওয়া লাগে"
তার বোনটা তখন কথা শিখেছে মাত্র।আধো আধো বুলিতে বলে,"বাবা চক্কেত কাবো"
তাদের খুশি আর ধরেনা।
হঠাৎ কি যেন হলো তার বাবা স্কুল থেকে ফিরলেন প্রচন্ড বুকে ব্যাথা নিয়ে।
ডাক্তার দেখানো হলো।জানা গেলো তার হার্টে ছিদ্র আছে।চিকিৎসা না করালে বাঁচার সম্ভাবনা নেই।
সব টাকা-পয়সা চোখের নিমিষেই চলে গেল।কিন্তু সাজ্জাদের বাবা আর ভালো হলেন না।উলটো কাজ করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললেন
তার মা এক টুকরো জমিতে এটা সেটা বুনে সাজ্জাদকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করালেন।
ভালো ছাত্র সাজ্জাদ একটা নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলো।
সেদিন খুশির চেয়ে বেশি শঙ্কিত হলো সাজ্জাদ। এত খরচ কিভাবে চালাবে মা?
শেষ পর্যন্ত আবাদি জমিটুকু বেচে সে ভর্তি হলো।চলে এলো শহরে।
কিন্তু এখন? কি করবে সে?টাকা কোথায় পাবে?
হঠাৎ খুব জোরে হর্ণের আওয়াজ হলো।পাশ ফিরে দেখে তন্বী ডাকছে,"ভাইয়া কি করছেন এই রাস্তায়?
আম্মু আপনাকে কাল বাসায় যেতে বলেছে।আমরা আজকেই ফিরলাম।এখন কোথায় যাচ্ছেন?আসুন নামিয়ে দেই আপনাকে"
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে তন্বী সাজ্জাদের দিকে চাইলো।
তার খুব মায়া হলো।দেখেই বুঝেছে তার খাওয়া হয়নি।ভাইয়া এমন কেন?
কাউকে কিচ্ছু বলেনা।কিন্তু দেখেই বুঝা যায় তার ভিতরে কত কষ্টের একটা নদী।
-নাহ তুমি বাসায় যাও।আমি কাল তোমায় পড়াতে আসবো।কলেজ থেকে ফিরে জানিয়ো আমায় কখন পড়বে।
কে শোনে কার কথা।গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে এলো তন্বী।
সাজ্জাদকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে গেলো গাড়িতে।
পাশাপাশি চুপচাপ বসে আছে দুজন।
-ভাইয়া,আপনার কি কিছু হয়েছে?
-কই নাতো!
-নাহ আমি নিশ্চিত কিছু হয়েছে।আপনি আমায় বলতে পারেন।
-তেমন কিছুই না।তোমার তো এতদিন পড়া হয়নি।সব কি ভুলে গেছো নাকি মাথায় এখনো কিছু আছে?
-আহা ভাইয়া আপনি মনে হয় জানেন না আমি কত্ত পড়ি।আর এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?বলুন কি হয়েছে?নইলে কিন্তু...
-নইলে কিন্তু কি তন্বী?
-আমি কেঁদে ফেলবো।
সাজ্জাদ ভেবে পায়না।ওর একটু কথা না বলাতে তন্বীর কান্নার কি আছে?অদ্ভুত মেয়েটা।
-কি বলে এই বোকা মেয়ে?
- বলুন তাহলে কি হয়েছে?
-আচ্ছা শোনো তাহলে।আমার বাবা খুব অসুস্থ। মা ফোন করেছিলেন।ঘরে টাকা নেই।খুব দরকার আমার টাকাটা।
-ঠিকাছে
বলেই মুখটা ভার হয়ে গেলো তন্বীর।সাজ্জাদ একটু তাকালেই দেখতে পেতো তন্বী কাঁদছে।
সাজ্জাদের মেসের সামনে আসলেও তন্বী ড্রাইভারকে বললো সাজ্জাদকে নিয়ে সে তন্বীর বাসায় যাবে।
-কিন্তু আমার তো তোমাকে কাল পড়ানোর কথা।
-হ্যাঁ কিন্তু আমি আজকেই পড়বো।চলুন!
বাসায় পৌঁছে তন্বী সোজা তার শোবার ঘরে ঢুকে গেলো আর সাজ্জাদ ড্রয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পরে তার ডাক পড়লো।
পড়ার ঘরে গিয়ে দেখে তন্বী কতশত খাবার সাজিয়ে রেখেছে তার জন্য।
-এসব কি তন্বী?
-আপনাকে দেখেই বুঝেছি আমি ভাইয়া,আপনি খান নি।এখন প্লিজ একটু কিছু খেয়ে নিন।আম্মু অনেক বকবে আমাকে আপনি না খেলে।
-কিন্তু আমার তো খিদে নেই।তুমি অযথাই এসব করলে।
-না খিদে পেলেও খাবেন।
অগত্যা সাজ্জাদকে খেতেই হলো।অনেকদিন পরে সে পেট পুরে খেলো।আর পুরোটা সময় তন্বী সাজ্জাদকে এক দৃষ্টিতে দেখছিলো।
সে জানেনা এই ছেলেটার প্রতি কেন এত মায়া?
কিসের টান তার?
এই কি তবে ভালোবাসা?
কিন্তু সাজ্জাদ ভাইয়াও কি তারমতোই ভাবে?
এসব ভাবতে ভাবতে তার মা একটা এনভেলপ নিয়ে এসেছে।
সে খামটা নিয়ে, থ্যাঙ্কিউ বলে তন্বীদের বাসা থেকে বের হলো।
পকেট থেকে খাম বের করে দেখলো তার পারিশ্রমিকের
টাকা দিয়ে দিয়েছেন আন্টি। উপরাওয়ালাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠিয়ে বাকিটা মেসের ভাড়া আর খাবারের টাকাটা চুকিয়ে দিলো সে।
সাথে মা কে কল দিয়ে বলে দিলো এবার বোনের জন্য একটা ভালো জামা বানিয়ে দিয়ো।
এতটুকু করতে পেরেই সাজ্জাদের আনন্দ আর যেন ধরছিলোই না।
পরদিন তন্বীকে পড়াতে গেলো সে।কিন্তু আজ তন্বীর কিছুতেই মন বসছিলো না পড়ায়।সে শুধু ভেবেই যাচ্ছে সাজ্জাদকে নিয়ে।কিভাবে জানবে যে ভাইয়ার মনে অন্য কেউ আছে কিনা?
সাজ্জাদকে সে সরাসরি বলেই বসলো
-ভাইয়া আপনার কি পছন্দের কেউ আছে?
-মানে?
-কাউকে ভালোবাসেন?
-বাসি।
উত্তরে তন্বী খুব আহত হলো।
-কে সে?
-আছে একজন। তার চোখ একদম বিলের মতো।
তার ভালোবেসে তাকে আমি বিলু বলি।
আহত গলায় তন্বী বললো,"ওহ"
সেদিন কিছুতেই পড়ায় মন বসলো না তন্বীর।
সাজ্জাদ চলে গেলো।
তন্বী মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলো।সাজ্জাদকে নিয়ে আর কোনোকিছুই সে ভাবতে রাজি নয়।যেভাবেই হোক পড়াশোনা করে ভুলে থাকতে হবে ভাইয়াকে।
কিছুদিন পর থেকেই তন্বীর পরীক্ষা শুরু হলো।
তন্বী বেশ ভালো রেজাল্ট করলো।
সাজ্জার পড়াতে আসে কিন্তু তন্বী কোনো কথা বলে না।সাজ্জাদেরও ভালো কাটেনা দিনগুলো।
সেদিন সাজ্জাদের তন্বীকে পড়ানোর শেষ দিন ছিল।তন্বীকে একটা বই আর ডায়েরি গিফট করলো সে।বললো,
-আমি চলে যাবার পরে খুলে দেখো।
তন্বী রাতে পড়া শেষ করে দেখলো ডায়েরির পাতাজুড়ে সাজ্জাদের লিখা তার জন্য একটা চিঠি।সে পড়তে শুরু করলো,
তন্বী,
জানিনা কিভাবে শুরু করবো!
আমার বাড়ির একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ হলাম আমি।মা খুব কষ্ট করে আমায় পড়ালেখা শিখিয়েছেন।আমার লক্ষ্যই হলো পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো।
তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে।তোমার পাশে দাঁড়ানোর মতো অনেক যোগ্য ছেলে পাবে তুমি।আমি জানি তুমি আমায় নিয়ে অনেক বেশিই ভেবে ফেলেছো।আমি যে ভাবিনি তা অস্বীকার করছিনা।গরীবের ছেলের ভালবাসা শোভা পায়না, তন্বী।কেন করছিনা তা আজ তুমি বুঝবেনা।সময় হোক তখন তুমিই বুঝে যাবে।
পারবে ততদিন আমার জন্য অপেক্ষা করতে? আমার বিলু হয়ে আমার মতো গরীবের ঘরে আসতে?"
ছোট্ট একটা চিঠি অথচ কত আকাঙ্ক্ষার তন্বীর কাছে তা শুধু সে ই জানে।
সেদিন চোখের জলে তন্বী সাজ্জাদকে বলেছিলো,"আমি পারবো তোমার বিলু হতে আমি পারবো তোমার জন্য অপেক্ষা করতে।"
আজ দশ বছর পরেও তন্বী সাজ্জাদের অফিসের সব গুছাতে গুছাতে বলে?
"কি গো?আরও অপেক্ষা করা লাগবে।"
সাজ্জাদ বলে," আমার বিলুকে আমি পেয়ে গেছি।আর কিসের অপেক্ষা? "
লেখক -ঈশিতা রায়